
ভুমিকা: আমার আজকের লেখাটি একটি পরিস্থিতির গল্প। নিউ ইয়র্ক শহরের সকল অভিবাসী ছেলে-মেয়েদের পরিস্থিতি বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের অভিবাসী ছেলে-মেয়েদের পরিস্থিতির দিকে আমার দৃষ্টি-ই আজকের লেখাটির বিশেষত্ব। নিউ ইয়র্ক শহরের আইন শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই অত্যাধিক অধিকারের ফলে তাদের পরিস্থিতির এক দুইটি দিক নিয়ে লিখলাম।
নিউ ইয়র্ক শহর একটি সার্বজনীন শহর কেননা পৃথিবীর প্রতিটি দেশের কোন না কোন মানুষেরই এই শহরের সাথে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দেনা পাওনার হিসাব রয়েছে। অপ্রীতিকর প্রাদেশিক মনোভাব কিংবা বহির্দেশীয়দের উপর ভয়ের কোন ভাব এই শহর সৃষ্টি করে না। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দেশ দেশান্তরের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত রাজ্য হতে অভিবাসন নীতির ভিত্তিতে প্রতিনিয়তই এই শহরে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ঘটে লোকের সমাগম। প্রথম জেনারেশনের প্রত্যেকেই এই শহরে তাদের নিজ নিজ চলাফেরায় স্বদেশের সব সংস্কৃতির রীতিনীতির বিভিন্ন অবস্থা ধরে রাখলেও শহরটির আইন শৃঙ্খলার বিধি নিষেধের এক সুর ও অভিন্ন অবস্থার কঠোরতার প্রতি সবাইকেই রাখতে হয় সজাগ দৃষ্টি। কিন্তু ব্যক্তি সত্তা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অনন্য সাধারণ মহিমায় উজ্জ্বল নিউ ইয়র্ক শহরের সামাজিক কাঠামোতে কিছু কিছু বিধি-নিষেধেদের কঠোরতা যেন পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কিছু কিছু ব্যাধির-ই জন্ম দেয়।
মহাকালের মহাবানী ‘মানব অধিকার’ কিংবা ‘মানবতা’ এর এক বিচিত্র শহর নিউ ইয়র্ক শহর। আইন শৃঙ্খলার বেড়াজালে আর অধিকার নামের ছাড়পত্রে স্বভাবের ভাব খুব তাড়াতাড়ি-ই শিকড় গজায় এই মানবতার মাটিতে। ফলে আইন শৃঙ্খলার প্রান্তিকতার দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসী পরিবার গুলোর ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও এই অধিকারের অনুভূতি অতি তাড়াতাড়ি-ই পরিক্রমে দানা বেঁধে উঠে। নিজের ছেলে-মেয়েদেরকে মৌখিক শাসন ব্যতীত অন্যান্য সব রকম শাসনের বিধি-নিষেধের কঠোরতার ফলে পরিবারের অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের জন্য জন্ম নেওয়া অতিরিক্ত অধিকারের ব্যাধি যেন পরিবারগুলোর উপর আরোপিত এক অসুস্থতা। পরিবারের অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের মানসিক বৃদ্ধির নিশ্চয়তায় তাদের উপর আইন শৃঙ্খলার তীর্যক দৃষ্টির ফলে অনেক ছেলে-মেয়ে-ই তাদের মা-বাবাদের ভয় ভীতির কথা না ভেবে মা-বাবাদের আয়ত্ত থেকে হাতছাড়া হয়ে অনির্দিষ্ট অস্থিরতায় বিভিন্ন রকম উপভোগের উপস্থিতিতে উচ্চ শিক্ষার মর্যাদা থেকে ঝরে পড়ে। চাওয়া পাওয়ার দেশে এই ধরনের ছেলে-মেয়েগুলোর ভবিষ্যতের জীবিকা নির্বাহের প্রসারিত প্রয়োজনে নিরবচ্ছিন্ন প্রান্তিক জীবনের সূচনা না থাকলেও তারা জীবন প্রান্তরের সীমানার সর্বত্রই দেখতে পায় পরিত্রানবিহীন পরিশ্রমের প্রতিচ্ছবি।
মানবতার জপের মালা হাতে নিয়ে আর মাল্টি কালচারের অক্ষয় মালা গলায় পড়ে সম অধিকারের ঘোষণা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিউ ইয়র্ক শহর অভিবাসীদের জন্য সত্যিই এক Daydream শহর। পরিশ্রমে প্রাপ্তি আর প্রাপ্তিতে অপচয়- এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে রূপ আর লাবন্যে গড়ে উঠা নিউ-ইয়র্ক শহরে কর্মসংস্থানের বিভিন্ন পথ বহু দিকে প্রসারিত। এই শহরে যেমনি রয়েছে সুপরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থার অসাধারণ সুবিধা তেমনি রয়েছে ইংরেজি না জানা অভিবাসী উদাসীনতাদের প্রতি সার্বক্ষণিক সাহায্য ও সহযোগিতার অগণিত হাত। তাই চোখের আকাশে আর মনের সূক্ষ্ম স্বপ্নে প্রাপ্তি ও অধিকার ভিত্তিক আদর্শ জীবন ধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ অভিবাসীরা-ই তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর কলোরল পেরিয়ে এসে উঠে এই শহরে।
অভিবাসী ছেলে-মেয়েগুলো সহ প্রতিটি ছেলে-মেয়ে-ই প্রতিভার বিকাশে পড়াশোনার জন্য স্কুলে পা রাখতে না রাখতেই হাতে পায় অধিকারের হাতে খড়ি। হাই স্কুলে অধ্যয়নরত ছেলে-মেয়েদের নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য অনুমতি থাকায় তারা কাজ করার সুবিধার্থে বিচিত্রের ছত্রছায়ায় স্বাচ্ছন্দের জীবনে পায় বিলাসের অজস্র উপকরণ। কয়েকটি মাস যেতে না যেতেই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক অভিবাসী ছেলে-মেয়ে-ই আমাদের দেশীয় মূল্যবোধের অনির্বাণ ঐতিহ্যের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আভিজাত্য ইংলিশ সংস্কৃতির দিকে না তাকিয়ে পোশাকে আশাকে ও কানে বালি আর শরীরে ট্যাটু (Tattoo) এঁকে এক বিজাতীয় মার (ভাতের ফেনা দিয়ে কাপড়ের বুনন ঘন ও শক্ত করার মতো) দেওয়া বহু সংস্কৃতির সংমিশ্রণের দিকে ধাবিত হয়, যা দেখে অসন্তুষ্ট ব্যতীত কখনোই সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। বেশ কিছু দিন নিউ ইয়র্ক শহরের হাই স্কুল গুলোতে Substitute Teacher হিসাবে কাজ করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছি যে বিদ্যার মন্দিরে পোশাক আশাকে লজ্জা এবং চলাফেরাতে সুন্দরের প্রবেশ যেন একেবারেই নিষেধ। শ্রেণীকক্ষ গুলোতে প্রবেশ করলেই আমার মনে হতো যেন প্রকৃতির এক বিকৃত রূপের মধ্যে আমার আগমন! শ্রেণীকক্ষে আমাদের অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের দুই-তিন জন ব্যতীত বাকি ছয়-সাত জনকে তাদের কথাবার্তায় ও চাল চলনে সংস্কৃতির সংমিশ্রণের এক চিত্রেই দেখতে পেতাম যারা অবশেষে মা-বাবাদের অনুশাসনের হাত অনুসরণ না করে অধিকারের হাত ধরে হারিয়ে যায় বহু সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ছিন্ন-ভিন্ন ও রুচিহীনতার বিবর্ণ গভীরতায়। ফলশ্রুতিতে আত্মিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মানসিক দীক্ষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করা ভারতীয় উপমহাদেশের অভিবাসী মা-বাবাদের জীবনে নেমে আসে তাদের পারিবারিক বেদনায় জ্বালাভরা হতাশার দীর্ঘশ্বাস।
আবার এমন অনেক অভিবাসী ও প্রথম জেনারেশনের ছেলে-মেয়ে রয়েছে যারা ভালো ভালো হাই স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়ে তাদের উজ্জ্বল প্রতিভার ভাস্বর আলোয় অত্যন্ত ভালো ফলাফল করে কলম্বিয়া, ইয়েল, এন.ওয়াই. ইউ., প্রিন্সটন, এম.আই.টি. প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে থাকে। এই ধরনের ইনস্টিটিউট গুলো থেকে মেডিকেলসহ অন্যান্য বিষয়ে তাদের অর্জিত কৃতিত্ব প্রশংসার পুষ্প বৃষ্টিতে তাদের মা-বাবা ও কমিউনিটির মুখ আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত করে।
অপরদিকে সবকিছুর অতীত হয়ে অধিকারের পরিবর্ধিত পরিস্থিতিতে গভীর পরিতাপের যে প্রতিচ্ছবিটি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের অভিবাসী মা-বাবাদের কল্পনার কল্পলোকে ভীতির কারণ হয়ে সব সময়ই প্রতিফলিত হয় তা হলো তাদের ছেলে-মেয়েদের বিবাহে বৈচিত্র কিংবা বিবাহে বৈচিত্রের সম্ভাবনা। অধিকারের এই অপরাজিত শহরে সামাজিক জীবনেও রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংযোগে হৃদয়ের অনুরাগের আলো পরিপূর্ণতা লাভের সামাজিক নাম ‘বিবাহে’ বিবিধ বৈচিত্র। শহরটিতে অনেকদিন থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে আমাদের অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে অসম ধর্ম কিংবা অসম সংস্কৃতির সমন্বয়ে শুভ পরিণয় গুলোর কিছুকাল শুভ কাটলেও তাদের জীবনের বহুকাল-ই কাটে অশুভ দৃষ্টি আর অসাড় হৃদয়ে পঙ্গু ভালবাসার অভিনয়ে অধঃপতনের প্রত্যেকটি স্তর প্রত্যক্ষভাবে অতিক্রম করে। তাদের কারো কারো মন পাখি আবার আরেক গাছে বাসা বাঁধলেও কারো কারো অন্তরের চিতাগ্নি সারা জীবন ব্যাপিয়া-ই জ্বলে। আমাদের অঞ্চলের বেশ কয়েকজন মা-বাবাকে দেখেছি যারা তাদের ছেলে-মেয়েদের অধর্ম অনুসারে ইচ্ছা অনুযায়ী প্রণয় গঠিত ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে পাওয়া ‘ছেলের বউ’ কিংবা ‘মেয়ের জামাই’ নামের উপহারটিকে উপেক্ষিত উপহার রূপে পাঁজর ভাঙ্গা বেদনায় চোখের জলে বরণ করে দূরে সরিয়ে দেয় তাদেরই চোখের অন্তরালে। নির্জনতা আর নিঃসঙ্গতার কণ্ঠরোধে পিছনের ফেলে আসা জীবনের উপর চোখ বুলিয়ে সেই মা-বাবারা সমালোচনার শিলাবৃষ্টিতে বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করে তাদের আপন নিবাসে অসীম নিঃশব্দতার পরিসরে।
তাই অধিকারের ছাড়পত্র নিয়ে মানবতার মহাদেশে সাম্য, মৈত্রী আর স্বাধীনতার দেশে এসে আর্থিক জীবন যাপনে জীবনের রঙ পুকুরের শ্যাওলা সবুজ থেকে সমুদ্রের নীলে রূপ নিলেও মানসিক দিক দিয়ে সেই স্বপ্ন সায়রে সাঁতার কাটা অনেকেরই হয়ে উঠে।
লেখক পরিচিতি— ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলের শাহবাজপুর গ্রামের দুর্দান্ত মেধাবী ছাত্র প্রিয় লাল দেবনাথ। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি ছাত্র জীবনে অত্যন্ত মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি শাহবাজপুর পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে এবং শাহবাজপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপোলে বৃত্তি পেয়েছিল। তিনি বর্তমানে আমেরিকার নিউইয়র্কের প্রবাসী। তাঁর জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা।
মোঃ রফিকুল হাসান সোহাগ
রিপোর্টার্স //